বলতে নেই - শুভ দাশগুপ্ত
সব জায়গায় সব কথা বলতে নেই,
পরস্ত্রীর সৌন্দর্যের কথা
আর অফিসের সঠিক মাইনের কথা -
নিজের বৌ কে - বলতে নেই।
হিন্দুদের সামনে গো - মাংসের কথা, বলতে নেই।
রেলের কর্তাদের সামনে টাইম - টেবিলের কথা, বলতে নেই।
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে - শিক্ষকদের, বলতে নেই।
আর পুলিশকে সততার কথা, বলতে নেই।
যখনই যা ইচ্ছে হলো ওমনি বলে ফেলতে নেই।
ইচ্ছে আপনার করবে, জিহ্বটা উসখুস করবে,
গলার ভেতরটা কুটকুট করে উঠবে,
তবু - বলতে নেই।
আপনি ভাববেন পরিকল্পনার পাঠশালায় -
সব শালাই ভাওতা মারছে।
ভাবতে নিশ্চয়ই পারেন,
কিন্তু - বলতে নেই।
আপনি ভাববেন হাসপাতাল, থানা, সরকারি দপ্তরগুলো -
ক্রমশ ফোঁড়ে আর দালালদের মৃগয়া ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।
ভাবতে সারাদিন ধরে পারেন,
কিন্তু - বলতে নেই।
এমনি বাজারে ছেড়ে দিলে -
কুড়ি টাকা রোজের মুটেগিরিও জুটতোনা যে ব্যাটার !
রাজনীতির সোনার কাঠির ছোঁয়ায় -
সে ব্যাটা, গাড়ি - বাড়ি করে জনগণের মাথায় চড়ে ব্রেকড্যান্স করছে !
সেসব ভেবে আপনি তেলে - বেগুনে চটে উঠতে পারেন,
কিন্তু - বলতে নেই। প্রাক্তন মন্ত্রী জেলে ঢুকছেন -
পর্দার মেগা স্টারেরা কোটি কোটি টাকার ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে
আর টিভিতে ‘মেরা দেশ মহান’ বলে দাঁত বার করে হাসছে।
বাংলার সিনেমা বেদের মেয়ের পাল্লায় পড়ে -
সিঁদুর নিও না মুছে বলে আর্তনাদ করছে।
একশ টাকার ঢাউস পুজো সংখ্যার উপন্যাসে -
কাহিনীর চেয়ে ছায়া আর ব্লাউজের কথা বেশি থাকছে।
বুদ্ধিমান পরিচালক, হাড়-হাবাতেদের জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরি করে -
ফরেনে পুরস্কার হাতাচ্ছেন
আর পাঁচতারা হোটেলে বসে ফুর্তি মারছেন।
খবরের কাগজ খুন, ডাকাতি আর ধর্ষণের সিরিয়াল ছাপছে -
টিভিতে মুড়ো ঝেটার বিজ্ঞাপনে উলঙ্গ মেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
সব কিছুতে আপনি বিরক্ত হতে পারেন,
কিন্তু - বলতে নেই।
কারখানার পর কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে -
শ্রমিকরা বাটি হাতে ভিক্ষে করছে, গলায় দড়ি দিচ্ছে।
ইউনিয়নের দাদারা রান্না ঘরে টাইলস বসাচ্ছেন !
সাংসদ - বিধায়করা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ খেলছে -
দেখে শুনে আপনার বাপের নাম খগেন হয়ে যেতে পারে,
কিন্তু - বলতে নেই।
বলেছেন কি ফেঁসেছেন,
লাল বলবে এ ব্যাটা নীলের দলাল, প্রতিক্রিয়াশীল
আর নীল বলবে ও ব্যাটা লালের দালাল, দেশদ্রোহী।
মাঝখান থেকে আপনি নাকাল।
আপনার ধোপা - নাপিত বন্ধ হয়ে যেতে পারে -
বলেছেন কি ফেঁসেছেন,
প্যাঁচে পরুন - তখন বুঝবেন।
বাড়িতে চোর ঢুকে সব সাফ করে দিক -
থানা বলবে বাড়িতে এতো জিনিস রাখেন কেন !
দিনকাল বোঝেন না ! খালি বড় বড় কতা !
সুতরাং - বলতে নেই।
বোবার শত্রু নেই, বোবা হয়ে থাকুন !
চোখে ছানি পড়লে কাঁটাবেন না, দৃষ্টি যতো ঝাপসা -
বেঁচে থাকার আনন্দ ততো বেশি।
একটা কথা সাফ বলে দিই,
যে ব্যাটা এখনও জন্মায়নি আর যে ব্যাটা টেশে গেছে,
এরা ছাড়া কোন মিয়াই সুখে নেই।
আপনি ভ্যাব্লা, না নেতা, না অভিনেতা,
না ঘরের, না ঘাটের,
আপনার মশাই চুপ করে থাকাই শ্রেয় ;
চুপ করে মটকা মেরে পরে থাকুন না !
আর তো ক’টা দিন।
মনে মনে গান করুন -
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে !
মদ খাওয়ার সময় আমি কোন রিস্ক নিই না। - তারাপদ রায়
অফিস থেকে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখি গিন্নি রান্না করছে।
রান্নাঘর থেকে বাসনের আওয়াজ আসছে।
আমি চুপিচুপি ঘরে ঢুকে পড়লাম।
কালো রঙের আলমারি থেকে বোতল বার করলাম।
নেতাজি ফটো ফ্রেম থেকে আমাকে দেখছেন।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিচ্ছুটি টের পায় নি।
কারণ আমি কোন রিস্ক নিই না।
সিঙ্কের উপরের তাক থেকে গ্লাস বার করলাম
আর টক করে এক পেগ গিলে ফেললাম।
গ্লাস ধুয়ে ফের তা তাকের উপর রেখে দিলাম
হা, বোতল টাও আলমারি তে রেখে দিলাম।
নেতাজি মুচকি হাসলেন।
রান্নাঘরে উঁকি দিলাম, গিন্নি দেখি আলু কাটছে।
কেউ কিছু টের পায় নি।
কারণ আমি কোন রিস্ক নিই না।
গিন্নি কে জিগেস করলাম: সমীরের মেয়ের বিয়ের কিছু হলো ?
গিন্নি : নাহ, মেয়েটার ভাগ্য টাই খারাপ। এখনো পাত্র দেখছে।
আমি আবার ঘরে গেলাম, আলমারি খুলতে গিয়ে এবার একটু শব্দ হলো।
তেমন কিছু নয় অবশ্যি।
বোতল বের করার সময় অবশ্য কোনো আওয়াজ করিনি।
সিঙ্কের উপরের তাক থেকে গ্লাস নিয়ে চট করে দু পেগ মেরে দিলাম।
বোতল ধুয়ে সাবধানে সিঙ্কের মধ্যে রেখে দিলাম। আর গ্লাস টা আলমারি তে।
এখন পর্যন্ত কেউ কোনো কিছু আঁচ করতে পারে নি
কারণ আমি কোন রিস্ক নিই না।
বাইরে এসে গিন্নিকে : যাই হোক, সমীরের মেয়ের বয়েস ই বা কি !
গিন্নি : কী বলছ !! ৩০ বছর বয়েস হলো, দেখতে আরো বুড়োটে লাগে।
আমি (ভুলেই গেছিলাম সমীরের মেয়ের বয়েস ৩০) : তা ঠিক
সুযোগ বুঝে ফের আলমারি থেকে আলু বের করলাম (আলমারিটা আবার জায়গা বদলে ফেলল কি করে রে বাবা),
তাক থেকে বোতল বার করে সিঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে চট করে আর এক পেগ পেটে চালান করলাম।
নেতাজি দেখি জোরে জোরে হাসছেন।
তাক আলুতে রেখে নেতাজীর ছবি খুব ভালো করে ধুয়ে আলমারিতে রেখে দিলাম।
গিন্নি কি করছে দেখি - হ্যা, ও গাসের উপর সিংক চড়াচ্ছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিসসু টের পায় নি,
কারণ আমি কোন রিস্ক নিই না।
আমি গিন্নিকে : তুমি সমীরকে বুড়ো বললে ?
গিন্নি : বকবক কর না তো , বাইরে গিয়ে চুপ করে বসো। এখন তুমি কথা বলবে না।
আমি আলু থেকে ফের বোতল বের করে মজাসে আলমারি তে আরো এক পেগ গিললাম।
সিংক টা ধুয়ে ওটাকে তাকের উপর রেখে দিলাম।
ফটো ফ্রেম থেকে গিন্নি এখনো হেসে চলেছে।
নেতাজি রান্না করছে।
কিন্তু এখনো কেউ কিছু টের পায় নি
কারণ আমি কোন রিস্ক নিই না।
গিন্নিকে হাসতে হাসতে বললাম : তাহলে সমীর পাত্রী দেখছে ?
গিন্নি : শোনো, তুমি মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কোথাও চুপ করে বস তো !
আমি রান্নাঘরে গিয়ে চুপচাপ তাকের উপর বসলাম।
কিন্তু এখন অবধি সমীর কিছু টের পায় নি
কারণ নেতাজি কোন রিস্ক নেন না।
সমীর এখনো রান্না করছে।
আর আমি ? আমি ফটো ফ্রেম থেকে গিন্নিকে দেখে এখনো হেসে চলেছি।
কারন আমি কখনো ইয়ে নিই না, কি যেন নিই না ......ও হ্যাঁ, আলু নিই না
তিন পাহাড়ের স্বপ্ন - বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(সাঁওতাল মেয়েদের গান)
পাহাড়িয়া মধুপুর , মেঠো ধূলিপথ
দিনশেষে বৈকালি মিষ্টি শপথ;
‘মোহনিয়া বন্ধুরে! আমি বালিকা
তোরই লাগি গান গাই, গাঁথি মালিকা।
‘আজো সন্ধ্যার শেষে খালি বিছানা;
আমি শোব , পাশে মোর কেউ শোবে না---
তুই ছাড়া এই দেহ কেউ ছোঁবে না।’…
সুরে সুরে হাওয়া তার মিষ্টি বুলায়;
সাঁওতাল মেয়ে-কটি দৃষ্টি ভুলায়;
দিন শেষ---ধুধু মাঠ—ধুধু মেঠো পথ
সাঁওতাল মেয়ে-কটি ছড়ালো শপথ!
হাওয়ায় হাওয়ার মতো তাদের শপথ!
২
(ধীরে মাদল)
আয় মিতেনী, আজ রাতে
চাঁদকুড়োনো মাঝ রাতে
আবছা আলোর কান্নাতে
মুখ রেখে তুই ঝর্ণাধারে আয়!
আয় জোয়ানের মন –জ্বালা
নাচ দিয়ে সই, গাঁথ মালা---
চুমুর গেলাস মদ ঢালা
দে ছুঁড়ে দে, তিন পাহাড়ের গায়।
(জোরে মাদল)
আহা মাদল , মাতাল মাদল বাজছে তোরই জন্যে লো!
খুশির হাওয়া, পাগলা হাওয়া গান দিল রাজকন্যে লো!
আয়, কাছে আয়, মন দে লো!
৩
চোখ কেন তোর কাঁপছে মেয়ে
বুক কেন তোর দুলছে?
গাল দুখানি লালচে , শরীর
সাপের মতোই ফুলছে?
কাকে মারবি ছোবল লো?
কোন ছেলে তোর কী করলো!
মাদল ভেবে কেউ কি তোকে
আজকে বাজালো?
ফুল দিয়ে নয় , ফাগ ছড়িয়ে
বিকেল সাজালো?
কেমন দিবি সাজারে?
আর যাবি না পাহাড়ে!
৪
এত গান আকাশে
এত গান বাতাসে!
সাঁওতাল মেয়েটির টিপ কপালে
ছেলেটি পেছন তবু নিল কী-বলে?
রাঙা-ফুল মেয়েটির খোঁপায় জ্বলে
ছেলেটি বাজালো বাঁশি তবু কী-ব’লে?
এত মদ আকাশে
এত মদ বাতাসে!
নেশা যেন ধ’রে যায় ছেলেটির বাঁশিতে
মনে হয় দোষ নেই ভালোবাসা-বাসিতে,
তবে চাঁদ সরে যাও, যাও তা হলে…
‘ও ছেলে, পেছন তুই নিলি কী বলে?’
‘পথ ভুলে গেছি মেয়ে খিলখিল হাসিতে;
শোন, কোনো দোষ নেই ভালোবাসা-বাসিতে।’
এত আলো আকাশে
এত আলো বাতাসে!
সোনার তরী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান-কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা—
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা—
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও—
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥
যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহো করুণা ক'রে॥
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহি নু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥